শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

প্রশ্নঃ এক বিষয়ে চার মাযহাবে ভিন্ন ভিন্ন মতামত আসে আমরা কোন মাযহাব মানব ?

প্রশ্নঃ এক বিষয়ে চার মাযহাবে ভিন্ন ভিন্ন মতামত আসে আমরা কোন মাযহাব মানব ?
ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ
সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আযাদ

উত্তরঃ “আমরা যারা মাযহাবের বিরুদ্ধে কথা বলি তারাও বিষয়টি বুঝি না, আহলে হাদিসেরও তো একই ব্যাপারে দশটি মত আছে, আপনি কোনটা মানবেন? আপনাকে কোনো না কোনো আলেমকে প্রাধান্য দিতেই হবে। বর্তমান সময়ে আরবের প্রসিদ্ধ তিনজন আলেম হলেন- শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানী রাহ., শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ., শায়েখ ছালেহ আলউছাইমিন রাহ.। রিয়াদের একজন মশহুর আলেম ড. সা‘দ আল বুরাইক রচিত ‘আল ইজায ফীমাখতালাফা ফীহিল আলবানী ওয়াল উসাইমিন ওয়াবনু বায মিনাল উসূলি ওয়াল ফুরু’। আলবানী, ইবনে বায এবং উছাইমিন এই তিন মহান পণ্ডিত আকীদা এবং ফিকহের যেসব বিষয়ে ইখতেলাফ করেছেন তার কিছু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এ বইতে রয়েছে। তাতেও প্রায় চারশ মত। বাংলাদেশের আহলে হাদীস আলেমদের ভেতরে ড. আসাদুল্লাহ গালিব, আমাদের আকরামুজ্জামান ভাই, শহিদুল্লাহ খান মাদানী, আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ রয়েছেন (আল্লাহ তাদের সবাইকে হেফাযত করেন)।
আমি তাদের সবাইকে মহব্বত করি, নাম ধরলাম শুধু বোঝানোর জন্য। তাদের ভিতরেও অনেক মাসআলায় মতভেদ আছে। ড. গালিব ওয়াজ করেছেন এক কুরবানীতে ৭ ভাগ হবে না, আকরামুজ্জামান ভাই বই লিখেছেন অবশ্যই ৭ ভাগ হবে। আমাদের মুযাফ্ফর বিন মুহসিন বই লিখেছেন, ১২ তাকবীরের সব হাদীস সহীহ, ৬ তাকবীরের সব হাদীস জাল। আকরামুজ্জামান ভাই বই লিখেছেন, ১২ তাকবীরের হাদীসও সহীহ, ৬ তাকবীরের হাদীসও সহীহ। এখন প্রশ্ন হলো আপনি কী করবেন? যেটাই মানেন আরেকজনের বিরুদ্ধে আপনাকে যেতেই হবে। মতভেদ থাকবেই, কারণ কুরআন এবং হাদীস হলো খাঁটি স্বর্ণ। খাঁটি স্বর্ণ কি গলায় পরা যায়? স্বর্ণের বার কী হাতের চুড়ি হিসেবে পরা যায়? বার দিয়ে চুড়ি বানাতে গেলে কী করতে হয়? খাদ মেশাতে হয়, তদ্রƒপ হাদীসকে জীবনের সাথে মেলাতে গেলে আলেমদের ইজতেহাদ করতে হয়। যেখানে হাদীস আছে সেখানেও করতে হয়, যেখানে নেই সেখানেও করতে হয়। যেমন মনে করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুক্রবারে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন, আর আরাফার দিন রোযা রাখতে আদেশ করেছেন (জুমহুর উলামায়ে কেরাম বলেছেন এটা মুস্তাহাব)। এখন আরাফার দিন শুক্রবার হলে কী করবেন? কোনো হাদীসে নেই- আরাফার দিন শুক্রবার হলে রোযা রাখবে। কোনো হাদীসে নেই- আরাফার দিন শুক্রবার হলে রোযা রাখবে না। এক্ষেত্রে দুটো হাদীসের সমন্বয়ের নাম হলো ইজতেহাদ।
আহলে হাদীসদের অনেক কাজ ভালো, তারা সহীহ হাদীস মানার চেষ্টা করেন, তারা বিদআত, র্শিক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। তাদের আরেকটা কাজ ভয়ংকর খারাপ। তারা ছোট ছোট ফিকহী মাসআলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাকে দ্বীন মনে করেন। রফউল ইয়াদাইন না করলে নামায হবে না, লা হাউলা ওলা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ! কোন্ হাদীসে আছে রফউল ইয়াদাইন না করলে নামায হবে না?! আবার যারা মাযহাব মানে তাদেরকে কাফের বলা, এটা তাদের আরেকটি ভয়ংকর কথা! মাযহাব মানা যে জায়েয, এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা আছে। যে মাযহাব মানে না বলে দাবি করে, সেও তো কাউকে না কাউকে মানে। আবার আমরা যারা মাযহাব মানি, আস্তে আমীন বলি, কোথাও কোথাও তাদের দেখি- জোরে আমীন বললে বা রফউল ইয়াদাইন করলে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। কোথাও কোথাও দেখি ঘোষণাও দেয়া হয়, ‘হানাফী মসজিদে’ কেউ জোরে আমীন বলতে পারবে না! বড় অবাক লাগে, মসজিদ শুধু হানাফীর না সব মুসলমানের?! যারা আল্লাহর দ্বীনকে ভাগ করে একটাকে হানাফী মসজিদ, একটাকে শাফিয়ী মসজিদ, অপর কোনোটাকে আহলে হাদীস মসজিদ বানায়- নবীর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, রফউল ইয়াদাইন করলে মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয় কিন্তু সুদখোর-ঘুষখোরদের মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয় না! আবার যারা জোরে আমীন বলে তাদের আচরণও আপত্তিকর! জোরে আমীন বলার জন্য সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে মসজিদ আলাদা করে ফেলবে?! মুসলমানদের ঐক্য রক্ষা ফরয, জোরে আমীন বলা ফরয না। বিশেষ করে যেখানে সবাই আস্তে আমীন বলে, দুই একজন জোরে বা উচ্চস্বরে আমীন বললে মুসল্লিদের নামাযে মনোযোগ নষ্ট হয়। যদি কেউ জোরে আমীন বলাকে উত্তম মনে করেন, তাহলে এমন জোরে বলবেন, যেন শুধু পাশের মুসল্লি শুনতে পায়। তাহলে সুন্নাত আদায় হয়ে গেল। আপনি যদি নফসের ইবাদত করেন আর ভাবেন- বিরাট কিছু হয়ে গেছি! আমি মুসলমানদের শেখাবো! তাহলে আমার কিছুই বলার নেই।
আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি মনে হয় র্শিক-কুফর বিদআত, আল্লাহর হক্ব, বান্দার হক্ব, ফরয, ওয়াজিব, হালাল-হারাম ইত্যাদি। এরপর এখতেলাফ থাকবে। আমি এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করি। এজন্য যারা র্শিক-কুফর, বিদআত ও মাজার পূজায় লিপ্ত যেমন, শিয়া-কাদিয়ানী, আটরশি, চন্দ্রপাড়া, মাইজভাণ্ডারী এবং ঐসব রেজভী-বেরলভী- যারা আকীদা ও আমলের বিভিন্ন শিরকে লিপ্ত। এদের কারও সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
আমার লেখালেখি ও আলোচনার মূল বিষয়ই হলো তাদের গোমরাহী থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করে তাওহীদ ও সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে আনা। তবে যারা মৌলিকভাবে কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলে এরূপ সকল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলকে আমি পছন্দ করি; কিন্তু আমি কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। বাংলাদেশের এরূপ দলগুলোর পারস্পরিক ঐক্য এবং মৌলিক বিষয়গুলোতে তারা একত্রে কাজ করুক এটা আমি কামনা করি এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধ নিরসনই আমার প্রত্যাশা। এজন্য তাদের কেউ ভালো কোনো কাজে আমাকে ডাকলে আমি তাদের ডাকে সাড়া দেই। আবার আমি আমার লেখায় ও আলোচনায় তাদের ভালো গুণগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের কোনো ভুল থাকলে সেটাও উল্লেখ করি।
আমাকে লোকজন গায়রে মুকাল্লিদ বলে। গায়রে মুকাল্লিদ বলার কারণ হলো আমি আমার আলোচনায় কুরআন ও হাদীসের দলিল ভিত্তিক দেয়ার চেষ্টা করি। আমার বইতে আহলে হাদীসদের নিন্দা করিনি। আবার অনেকে অনেক কিছু বানিয়েও বলে। আহলে হাদীসরাও আমাকে হানাফী বলে। কারণ তারা আশা করেছিলো আমি মাযহাবের বিরুদ্ধে কথা বলবো। অথচ আমি মাযহাবের বিরোধিতাকে জায়েয মনে করি না।
আবার কেউ বলে, আমি ‘গোপন আহলে হাদীস’, কেউ বলে, ‘গোপন হানাফী’! এমন অনেক কথা আমাকে শুনতে হয়। আমি মৌলিকভাবে মাযহাব মানি। আরও স্পষ্টভাবে বললে আমি হানাফী মাযহাব অনুসরণের চেষ্টা করি। আমি মনে করি, ফিকহের ইজতিহাদের যোগ্যতা আমার নেই। তবে যদি কখনো কোনো মাসআলায় সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহ এবং ইমামগণের মতামত দেখার পরে কারো ‘কওল’কে আমি কুরআন-সুন্নাহর অধিকতর নিকটবর্তী মনে করি এবং আমার ইতমিনান হয়, আমি তাঁর মত গ্রহণ করি। এর বিপরীত মতের পক্ষেও যদি সহীহ হাদীস থাকে তাহলে সে অনুযায়ী আমল করাকে কখনো খারাপ মনে করি না। বান্দা তার দ্বীনের ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে সরাসরি ‘মুহাসাব’। কাজেই আমার ইতমিনান হলো বড় বিষয়। এক্ষেত্রে মাযহাবের খেলাফ করাটাকে নাজায়েয মনে করি না। এতে আমার মাযহাব নষ্ট হয়, তাও মনে করি না। আমি মাযহাবী বা গায়রে মুকাল্লিদ কি না, এটা বলতে পারবো না। তবে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী রাহ. যেভাবে মাযহাব মেনেছেন আমি ঐ ধরনের মাযহাব মানি। এরকম মানাতে যদি মনে হয় আমি মাযহাবের অনুসারী তাহলে মাযহাবের অনুসারী।
যদি হানাফী হওয়ার অর্থ হয় ভারতবর্ষের হানাফী আলেমদের সকল মত মেনে নিতে হবে। তাহলে এমন হানাফী হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। হানাফী হওয়ার নামে কঠোরতা আমি পছন্দ করি না। আমি রফউল ইয়াদাইন করি না। তবে কেউ রফউল ইয়াদাইন করলে খারাপ লাগে না। শাফেয়ী বা হাম্বলী হিসেবে রফউল ইয়াদাইন করলে দোষ নেই আর আহলে হাদীস হিসেবে করলে দোষ!- এটা আমি মানতে পারি না। তবে সে যদি রফউল ইয়াদাইন করার পাশাপাশি বিপরীত মতকে মন্দ বলে তাহলে তার কথাটি মন্দ কিন্তু তার আমল তো মন্দ হয়নি। কেউ যদি মুতাদিল আহলে হাদীস হন, আহলে হাদীসের মাসআলাগুলোকে তারজীহ দেন, সহীহ হাদীসের ওপর থাকেন, জুমহুরের মাসলাক অনুযায়ী আমল করেন, বিপরীত মতগুলোকে আপত্তিকরভাবে ইনকার না করেন, তাহলে আমার আপত্তি নেই। আমি এটাকে খারাপ মনে করি না। কিন্তু তিনি আহলে হাদীস নাম দিয়ে সমাজে প্রচলিত জায়েয-মুবাহকে হারাম বলবেন, দলিলভিত্তিক মতকে মন্দ বলবেন, মাযহাব মানাকে হারাম বলবেন, আর নিজে মাযহাব তৈরি করবেন, গালিগালাজ করবেন, সেটা আমি অপছন্দ করি। আমার কাছে এটা মুনকার। আল্লাহ তাআলা এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। যারা মাযহাবের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলে, আমি তাদের সাথে প্রোগ্রাম করি না। কখনো সরাসরি নিষেধ করি। আবার কখনো কৌশলে এড়িয়ে চলি। যখন কেউ আমাকে বলে মাযহাবের মাধ্যমে দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে, আমি বলি, না; বরং আহলে হাদীসের মাধ্যমে দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে যেটা প্রচলিত আছে এবং তার পক্ষে আমি দলিল পাচ্ছি, এটা নিয়ে ঝগড়া করার দরকার কী? সৌদি আলেমদেরকে এটা নিয়ে ঝগড়া করতে দেখিনি। ফিকহী ব্যাপারে আমি মনে করি, এই তার্ফারুক (বিভেদ) ঠিক না, এটা উম্মতের ক্ষতি করে।
আমাকে উদ্দেশ্য করে একজন বলেছে, “আপনি যদি আহলে হাদীস হন, তাহলে ভালো আহলে হাদীস, আপনি হানাফীদের মহব্বত করেন। আর যদি হানাফী হন, তাহলে ভালো হানাফী যে আহলে হাদীসদের মেনে নেন।”
উৎসঃ বাংলাদেশ ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন